Saturday 9 February 2019

ইসলামী অর্থনীতি কি?
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও তাঁর রাসূল (সা.) প্রদত্ত জীবন বিধানের নাম ইসলাম। যেহেতু ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান সেহেতু এর অনুসারীদের জন্যে ব্যক্তিজীবন, গোষ্ঠীজীবন, সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় জীবনের দায়-দায়িত্ব ও অধিকার-কর্তব্য পালনের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ও উপযুক্ত নীতিমালা ইসলামে রয়েছে। এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, আইন ও বিচার প্রভৃতিও। অর্থনীতি বা লেনদেনগত আলোচনা যে কোন জাতি বা রাষ্ট্রের জন্যে অপরিহার্য একটি প্রসঙ্গ। ইসলামী জীবন বিধানের অনুসারীদের জন্যেও একথা সত্য। তাই ইসলামী অর্থনীতি বলতে ঐ অর্থনীতিকেই বোঝায় যার আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, কর্মপদ্ধতি এবং পরিণাম ফল ইসলামী আকিদা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। 

[ইসলামী অর্থনীতির সংজ্ঞা ও মূলনীতি, লেখক- ড. মো. ইব্রাহীম খলিল]

ইসলামী অর্থনীতির সংজ্ঞা
বর্তমান সময়ের কয়েকজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ইসলামী অর্থনীতির একটি সুসংবদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদানের চেষ্টা করেছেন। সেসবের মধ্যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য দুটি সংজ্ঞা প্রদত্ত হলো—
এক. 
ড. এস. এম. হাসানউজ্জামানের মতে- 

“Islamic Economics is the knowledge and application of injunctions and rules of the Shariah that prevent injustice in the acquisition and disposal of material resources in order to provide satisfaction to human beings and enable them to perform their obligations to Allah and the society.”

   [Hassanuz Zaman, S.M., “Definition of Islamic Economics”]

অর্থাৎ, ইসলামী অর্থনীতি হচ্ছে শরীয়াহর বিধি-নির্দেশ সম্বন্ধীয় জ্ঞান ও তার প্রয়োগ যা বস্তুগত সম্পদ আহরণ ও বিতরণের ক্ষেত্রে অবিচার প্রতিরোধে সমর্থ যেন এর ফলে মানবম-লীর সন্তুষ্টি বিধান করা যায়। ফলে আল্লাহ ও সমাজের প্রতি তারা দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সক্ষম হবে।
  [ইসলামী অর্থনীতির পরিচয়, লেখক- এমএম হাসানুজ্জামান]

দুই. 
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ডা এম. উমার চাপরার মতে- 

“Islamic economics is that branch of knowledge which helps realize human wellbeing through an allocation and distribution of scarce resources that is in conformity with Islamic teachings without unduly curbing individual freedom or creating continued macroeconomic and ecological imbalabces.”

   [Chapra, M. Umer, What is Islamic Economics? Islamic Research and Training Institute, Islamic Development Bank, Jeddah, 1996, p. 33]

অর্থাৎ, ইসলামী অর্থনীতি জ্ঞানের সেই শাখা যা ইসলামের শিক্ষার সাথে সংগতি রেখে দুষ্প্রাপ্য সম্পদের বন্টন ও বরাদ্দের মাধ্যমে এবং ব্যক্তির স্বাধীনতা অযথা খর্ব ও সমষ্টি অর্থনীতি এবং পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি না করে মানবীয় কল্যাণ অর্জনের সহায়তা করে।

    [ডা. এম উমর চাপরা, ইসলামী অর্থনীতি কি?, ইসলামিক রিসার্চ এণ্ড ট্রেনিং ইনিস্টিটিউট, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জেদ্দা, ১৯৯৬, পি-৩৩]

অর্থনীতির প্রকারভেদ
মোটা দাগে অর্থনীতি প্রধাননত তিন প্রকার হতে পারে। যথা : 

১. ইসলামী অর্থনীতি। 
২. অনিসলামী অর্থনীতি বা সাধারনণ অর্থনীতি। ৩. ইসলামবিরোধী অর্থনীতি।

১. ইসলামী অর্থনীতিঃ-
সলামী অর্থনীতি বরতে সম্পদ উপার্জন, প্রাপ্তি, বিনিময়, বিনিয়োগ, বিতরণ, ভোগ ও
ব্যবহারের ইসলামী শরীয়াহসম্মত নীতি অনুসৃত হওয়া বাঞ্চনীয় বা এই নীতি মানতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
২. অনিসলামী অর্থনীতি বা সাধারণ অর্থনীতি :- 
যে অর্থনীতি ইসলামী পদ্ধতি অনুসরণে অঙ্গীকারাবদ্ধ নয় এবং ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিকও নয়।
৩. ইসলামবিরোধী অর্থনীতি :-
 যে অর্থনীতির পদ্ধতি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। 

[শাইখ মুফতি উসমান গণী লিখিত ইসলামে অর্থনৈতিক রূপরেখা]

ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি

প্রতিটি অর্থব্যবস্থা বা অর্থনীতির মতো ইসলামী অর্থনীতির কিছু মূলনীতি বা মূল বিষয় রয়েছে। আর এই সব মূলনীতিই মূলত ইসলামী অর্থনীতির প্রাণ বা মূল ভিত্তি। কোরআন ও হাদিস আলোকে মোটা সাতটি বিষয়কে ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ বা সাব্যস্ত করা হয়-

এক. অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের পার্থক্য করা :  
ইসলাম মনে করে সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে মানুষের অবাধ স্বাধীনতা নেই। বরং আল্লাহ যে উপায়ে উপার্জন করাকে হালাল করেছেন, কেবল সে উপায়েই উপার্জন করা যাবে। 
আল্লাহ বলেন, 
হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। (৪:২৯)

দুই. সম্পদ কুক্ষিগত করতে নিষেধাজ্ঞা : 
ইসলাম মানুষকে ইচ্ছে মতো সম্পদ সঞ্চয় করে রাখতে নিরুৎসাহিত করে। 
আল্লাহ বলেন, 
আল্লাহ তাদেরকে নিজের অনুগ্রহে যা দান করেছেন তাতে যারা কৃপণতা করে এই কার্পন্য তাদের জন্য মঙ্গলকর হবে বলে তারা যেন ধারণা না করে। বরং এটা তাদের পক্ষে একান্তই ক্ষতিকর প্রতিপন্ন হবে। যাতে তারা কার্পন্য করে সে সমস্ত ধন-সম্পদকে কিয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ী বানিয়ে পরানো হবে। আর আল্লাহ হচ্ছেন আসমান ও যমীনের পরম সত্ত্বাধিকারী। আর যা কিছু তোমরা কর; আল্লাহ সে সম্পর্কে জানেন। 
(৩:১৮০)

তিনি আরো বলেন,
আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। 
(৯:৩৪)

চার. ব্যয়-বিনিয়োগের নির্দেশ : 
সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার পরিবর্তে ইসলাম নির্দেশ দেয় তা প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করার এবং ব্যবসায় বিনিয়োগ করার। 
 জানা রয়েছে। 
(২:২১৫)

তিনি আরো বলেন, 
এবং তাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক ছিল। (৫১:১৯)

পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় মনে করা হয়, সম্পদ সুদভিত্তিক বিনিয়োগ করলে অতিরিক্ত মুনাফা হবে। ইসলাম তা অস্বীকার করে। 
আল-কুরআন ঘোষণা দেয়, 
আল্লাহ তা’আলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খয়রাতকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ পছন্দ করেন না কোন অবিশ্বাসী পাপীকে। 
(২:২৭৬)

আল্লাহ বলেন, 
মানুষের ধন-সম্পদে তোমাদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, এই আশায় তোমরা সুদে যা কিছু দাও, আল্লাহর কাছে তা বৃদ্ধি পায় না। পক্ষান্তরে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পবিত্র অন্তরে যারা দিয়ে থাকে, অতএব, তারাই দ্বিগুণ লাভ করে। 
(৩০:৩৯)

সুদভিত্তিক বিনিয়োগের কারণে সম্পদ একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর হাতে চলে যায়। গরীবের হাতে সম্পদ থাকে না। ফলে তাদের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায়। যা বাজারের সামগ্রিক চাহিদা কমিয়ে দেয়। ফলে শিল্প-কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায় ও বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এক কথায়, পুরো অর্থব্যবস্থা থমকে দাঁড়ায়।

পাঁচ. পরস্পরকে সহযোগিতা করা :
পরস্পরকে সহযোগিতা করা ইসলামী অর্থব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। 
আল্লাহ বলেন, 
"যদি খাতক অভাবগ্রস্থ হয়, তবে তাকে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দেয়া উচিত। আর যদি ক্ষমা করে দাও, তবে তা খুবই উত্তম যদি তোমরা উপলব্ধি কর। "(২:২৮০)

অনুরূপভাবে আল্লাহ তা’আলা নিভৃতে মানুষকে দান করতে উৎসাহিত করে বলেন, 
"যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর, তবে তা কতইনা উত্তম। আর যদি খয়রাত গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তদের দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্যে আরও উত্তম। আল্লাহ তা’আলা তোমাদের কিছু গোনাহ দূর করে দিবেন। আল্লাহ তোমাদের কাজ কর্মের খুব খবর রাখেন।" 
(২:২৭১)

ছয়. যাকাত : 
প্রয়োজনিতিরক্তি সম্পদ যদি থাকে, তাহলে তার একটি নির্দিষ্ট অংশ অবশ্যই গরীবদের মাঝে বন্টন করে দেয়া। 
যাকাত নির্দেশ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন, "তাদের মালামাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর যাতে তুমি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং সেগুলোকে বরকতময় করতে পার এর মাধ্যমে।" 
(৯:১০৩)

সাত. মিরাস : 
ধন-সম্পদ সুষম বন্টনের পরও যা অবশিষ্ট থাকে, মৃত্যুর পর তা বিক্ষিপ্ত করা ও ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ইসলাম এ বিধান রেখেছে।

[ইসলামী অর্থনীতির রূপরেখা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, লেখক- মুফতি ইউসুফ সুলতান,]

ইসলামী লেনদেনের বৈশিষ্ট্য
ইসলামী লেনদেনে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ এইসব বৈশিষ্ট্যকে ইসলামী অর্থনীতির রূহ বলেছেন। আর সেগুলো হলো- 

১. সুদমুক্ত হওয়া। 
২. ক্ষতির অংশীদারিত্ব থাকা (Risk Sharing)। 
৩. প্রকৃত সম্পদের ওপর প্রতিষ্ঠিত অর্থায়ন (Asset based Financing)। 
৪. চুক্তিতে সবকিছু নির্দিষ্ট ও নিশ্চিত করা; কোনো অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতা না রাখা। 
৫. হালাল সম্পদের লেনদেন করা। 

[ইসলামী অর্থনীতির রূপরেখা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, লেখক- মুফতি ইউসুফ সুলতান]

ইসলামী অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তা
ইসলামি অর্থনীতি ও ঈমান অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এটি ইসলামি অর্থনীতির সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ইসলামি অর্থনীতি থেকে যদি এ বৈশিষ্ট্যকে তুলে নেয়া হয় তাহলে সেটি মুখ থুবড়ে পড়বে। সফলতার আলো দেখতে পাবে না কখনো। আর একজন মুসলিমতার জীবনে কখনো ইমানহীন অর্থব্যবস্থা বা অর্থনীতিকে তার জীবনে গ্রহণ করতে পারে না বা করা উচিত না।
হালাল উপার্জন ছাড়া কোনো ইবাদাত কবুল হয় না।
 রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, 
হারাম সম্পদে গঠিত কোনো দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ 
উক্ত হাদিসটি থেকে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে, অর্থনীতিকে ইসলামী শরীয়াহর আদলে ঢেলে সাজানো ঠিক কতটা জরুরি। হালাল উপার্জন এবং এর মাধ্যমে একজন মুসলিমের পরলৌকিক সফলতা অর্জনের নিমিত্তে ইসলামী অর্থব্যবস্থা বা অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তা অপরীসীম।
আর ইসলামী ব্যাংকিং ইসলামী অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা এবং ইসলামী অর্থনীতি ইসলামী জীবনব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারণ ইসলামী শরীয়াহ প্রধানত দুটি শাখা রয়েছে। ইবাদত ও মুআমালাত (লেনদেন ও আচার-আচরণ)। আর রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে সাধারণত ২ ঘণ্টা সময় আল্লাহ্ তাআলা আনুষ্ঠানিক ইবাদাতের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেনে। বাকী ২২ ঘণ্টা সময় মুআমালাত-এর মধ্য দিয়ে প্রত্যেক মানুষকে অতিবাহিত করতে হয়। আর মুআমালাত-এর বিশাল অংশ জুড়েই রয়েছে ইসলামী অর্থব্যবস্থা। এ অর্থব্যবস্থার প্রধান সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ব্যাংক। সুতরাং ইসলামী ব্যাংকিংকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ।
এছাড়া আরো কিছু কারণ বা বৈশিষ্টের বিবেচনায় ইসলাম অর্থনীতির গুরুত্ব ও প্রয়োজণীয়তা অপরীসীম। সে কারণ বা বৈশিষ্ট্যগুলো হলো-

এক. 
ইসলামী অর্থনীতি কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক।

দুই. 
ইসলামী অর্থনীতি একটি সার্বজনীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। সব যুগের সব মানুষের অধিকার পূরণের কথা বলা হয়েছে।

তিন. 
ইসলামী অর্থনীতির সাম্যবাদী রূপ সব মহলে প্রশংসার দাবিদার। এতে ধনী-গরিব, আশরাফ-আতরাফ, আরব-অনারব, শাসক-শাসিত ইত্যাদি শ্রেণীর মানুষের হক, অধিকার ও দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে।

চার. 
মানবকল্যাণ। সর্বাধিক মুনাফা অর্জন নয় অথবা সম্পদ কুক্ষিগত করা নয়­ মানবকল্যাণ নিশ্চিত করা ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

পাঁচ. 
ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পদ আমানত। 

Thursday 7 February 2019

ঘুষের ভয়াবহতা এবং তা থেকে পরিত্রাণের উপায়

  •  আলহামদুলিল্লাহ ওয়াল শুকরু লিল্লাহ ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আ'লা হাবিবিহিল কারিম।।আম্মা বা'দঃ-   


ঘুষ একটি সামাজিক ব্যাধি। ঘুষ হচ্ছে স্বাভাবিক ও বৈধ উপায়ে যা কিছু পাওয়া যায় তার উপর অবৈধ পন্থায় অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করা। কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী তার দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়মিত বেতন/ভাতা পাওয়া সত্ত্বেও যদি বাড়তি কিছু অবৈধ পন্থায় গ্রহণ করে তাহলে তা ঘুষ হিসাবে বিবেচিত। অনেক সময় স্বীয় অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ঘুষ দেওয়া হয়। আবার অনেক সময় টাকা-পয়সা ছাড়াও উপহারের নামে নানা সমগ্রী প্রদান করা হয়। সুতরাং যেভাবেই হোক, আর যে নামেই হোক তা ঘুষের অন্তর্ভুক্ত। 
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الرَّاشِي وَالْمُرْتَشِي»

“ঘুষ প্রদানকারী ও গ্রহণকারী উভয়ের উপরই আল্লাহর লা‘নত[1]।”
সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল পদে থেকে হারাম অর্থ গ্রহণই হচ্ছে ঘুষ। এই ঘুষ যারা দেয় তারাও সমান অপরাধী। বেআইনী ফায়দা হাসিলের জন্য যারা কর্তাব্যক্তিদেরকে বিভিন্ন সুবিধা বা টাকা পয়সা দিয়ে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করে তারাই এই গুনাহ সংঘটনের অন্যতম শরীক। যারা ঘুষকে একটি অঘোষিত ব্যবস্থা হিসেবে প্রশ্রয় দেয় তারাই অপরাধী। দেখা যায় মাঝে মধ্যে বেড়াই ক্ষেত খায়, রক্ষকই হয় ভক্ষক। ন্যায়কে যাদের লালন করার কথা তারাই অন্যায়কে ধারণ করছে। এভাবে দুর্নীতির ডালপালা সারা দেশে বিস্তার লাভ করে।
ঘুষ বা উৎকোচ আসে নজরানার রূপ ধরে। “নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন সাহাবীকে কর্মচারী নিয়োগ করে যাকাত আদায়ের জন্য পাঠালেন। সে ফিরে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, এটা যাকাতের মাল আর এটা আমাকে উপঢৌকনস্বরূপ দেওয়া হয়েছে। এতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে বললেন- সরকারী কর্মচারীর কি হলো! আমরা যখন তাকে কোনো দায়িত্ব দিয়ে কোথায়ও প্রেরণ করি তখন সে ফিরে এসে বলে এই মাল আপনাদের (সরকারের) এবং এটা আমাকে প্রদত্ত উপহার। সে তার বাড়িতে বসে থেকে দেখুক তাকে উপহার দেওয়া হয় কি-না[2]।”
একবার এক সরকারী উর্ধ্বতন কর্মকর্তা উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-কে কিছু উপহার দিলেন। উপহারগুলো দেখে উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছিলেন- তুমি যে বললে এগুলো বায়তুলমালের আর এগুলো আমার উপহার! তুমি এই পদ ছেড়ে বাপের ঘরে বসে থাক, দেখ তো কে তোমার জন্য উপহার নিয়ে আসে।” সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করার এই জ্ঞান ও সাহসের জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আল-ফারুক উপাধি দিয়েছিলেন। 
কবি ফররুখ বলেছেন-
“আজকে উমর পন্থী পথিক দিকে দিকে প্রয়োজন
পিঠে বোঝা নিয়ে পাড়ি দেবে যারা প্রান্তর প্রাণপণ।”
কিন্তু হায়! এখন মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের এই সমাজের চিত্র দেখলে প্রশ্ন জাগে ইসলামের সেই মহান শিক্ষার প্রতিফলন কোথায়?
 এ জন্যেই কবি নজরুল বলেছেন:
ইসলাম সে তো পরশ মানিক তারে কে পেরেছে খুঁজি,
পরশে তাহার ধন্য যারা তাদেরই আমরা বুঝি।
ইসলামের পরশ আমাদের কলবে পৌঁছেনি বলেই আজ আমরা ঘুষকে উপহার ভাবি। অফিসের ফাইল ঘুষ না পেলে সামনে চলে না। যার ফলে দেশ ও জাতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয় না। কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে মেধাহীনদের রাজত্ব চলে। ঘুষ দিয়ে যে চাকুরী পেতে হয় সেই চাকুরীকে সেবা মনে করার কোনো কারণ নেই। আর তাই ঘুষ দিয়ে শিক্ষকের চাকুরী পাওয়া লোকটির কাছ থেকে তার ছাত্ররা কতটুকু এলেমদার হবে তা নিয়ে মনে অনেক সংশয় থেকে যায়।
এই ঘুষের জামানায় পাকা দড়িবাজরা তরতর করে উপরে উঠে যাচ্ছে দেখে আল্লাহর নেক বান্দারা মাঝে মাঝে ভাবে, যে কি নেক নিয়তের কি কোনো দাম নেই? এটা কি বোকামি? কিন্তু তিতা ফলের চারা লাগিয়ে যেমন সুমিষ্ট ফলের আশা করা যায় না তেমনি দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে উঠা ব্যবস্থাপনার কাছে কোনো কল্যাণ আশা করা যায় না। তাই ঘুষ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন:

﴿فَبَدَّلَ ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ قَوۡلًا غَيۡرَ ٱلَّذِي قِيلَ لَهُمۡ فَأَنزَلۡنَا عَلَى ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ رِجۡزٗا مِّنَ ٱلسَّمَآءِ بِمَا كَانُواْ يَفۡسُقُونَ ﴾ [البقرة: ٥٩]

“এরপর যালিমরা বদলে দিল যা তাদের বলা হয়েছিল। তার পরিবর্তে অন্য কথা। এ কারণে যারা যুলুম করল তাদের উপর নাযিল করলাম আকাশ হতে এক মহাশাস্তি। কারণ, তারা অধর্ম-অন্যায় কাজ করেছিলো।” 
(আল-কুরআন, ২:৫৯)
এ আয়াতে সত্যকে বদলে দেওয়ার শাস্তির উল্লেখ আছে। ঘুষও সত্যকে বদলে দেয়। পাসকে ফেল দেখিয়ে দেয়। একজন হকদারের হক বদলে দিয়ে অন্যকে অন্যায়ভাবে দেওয়া হয়।
অতীত যামানায়  যারা ঘুষ গ্রহণ করত, দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ধর্মের বাণীতে জালিয়াতি করত তাদের সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে:

﴿ فَوَيۡلٞ لِّلَّذِينَ يَكۡتُبُونَ ٱلۡكِتَٰبَ بِأَيۡدِيهِمۡ ثُمَّ يَقُولُونَ هَٰذَا مِنۡ عِندِ ٱللَّهِ لِيَشۡتَرُواْ بِهِۦ ثَمَنٗا قَلِيلٗاۖ فَوَيۡلٞ لَّهُم مِّمَّا كَتَبَتۡ أَيۡدِيهِمۡ وَوَيۡلٞ لَّهُم مِّمَّا يَكۡسِبُونَ ٧٩ ﴾ [البقرة: ٧٩]

সুতরাং দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব রচনা করে এবং তুচ্ছ মূল্য প্রাপ্তির জন্য বলে- এটি আল্লাহর নিকট হতে এসেছে। তাদের হাত যা রচনা করেছে তার জন্য শাস্তি তাদের এবং যা তরা উপার্জন করে তার জন্যও শাস্তি তাদের।”
 (আল-কুরআন, ২:৭৯)
ঘুষ হচ্ছে একটি হারাম জিনিস। যদিও ঘুষখোর এটাকে হারাম মনে করে না। আয়াতে ঘুষ খেয়ে ধর্মের বাণী বদলে দেওয়ার কথা বলা হলেও সকল জালিয়াতির জন্যই শাস্তি প্রযোজ্য।
ঘুষ সব সময় টাকা-পয়সা হয় না। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানান বস্তু ও বিষয় হতে পারে। এ জন্যই হাদীসের ভাষায় এটিকে বলে ‘রিশওয়াহ’ বা দড়ি। দড়ি দিয়ে কুপের ভেতর থেকে বালতি টেনে উঠাবার মত ঘুষ অন্যের হক নিজের ঘরে নিয়ে আসে। এজন্য এই প্রক্রিয়ায় তিনটি পক্ষ থাকে। ১. রাশী راشى যে ঘুষ প্রদান করে, ২. মুরতাশী مرتشى যে ঘুষ গ্রহণ করে এবং ৩. রায়েশ رائش যে অনুঘটক হয়ে কাজ করে। আল্লামা সান‘আনী তার বিখ্যাত গ্রন্থ সুবুলুস সালাম শারহু বুলুগিল মারাম গ্রন্থে বলেন- রায়েশ বা ঘুষের ঘটক হচ্ছে্ ওই ব্যক্তি যে ঘুষখোর ও ঘুষদাতার মধ্যে যোগাযোগ ঘটিয়ে থাকে।[3] তবে মূলপক্ষ হচ্ছে দুটি: যে ঘুষ দেয় ও যে ঘুষ খায়।
আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«لعنة الله االراشي والمرتشي في الحكم »

“ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়ের ওপর আল্লাহর লা’নত।”[4]
ইমাম তাবারানী তার আল-মু‘জামুস সগীর গ্রন্থে একটি হাদীস সংকলন করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

 « الرشوة في الحكم كفر وهى بين الناس سحت»

‘রিশওয়াহ বিচারের ক্ষেত্রে কুফরি। লোকেরা নিজেদের মধ্যে এ কাজ করা সুহত।” 
আগেই বলা হয়েছে রিশওয়াহ অর্থ ঘুষ। তাহলে সুহত অর্থ কি? এ প্রশ্নের উত্তর পাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি হাদীসে:

«كل لحم أنبتته السحت فالنار أولى به، قيل ما السحت ؟ قال الرشوة في الحكم»

“যে গোশত উদগত হয়েছে সুহত থেকে, তার জন্য জাহান্নামের আগুনই বেশি উপযোগী। একজন জিজ্ঞেস করলো, সুহত কী? তিনি বললেন, বিচার বা শাসনকার্যে ঘুষ গ্রহণ।”[5]
তাহলে দেখা যায় যে, ঘুষের অর্থে যে নিজে পানাহার করে এবং তার পোষ্যদের পানাহার করায় সকলের জন্যই তা খুবই মন্দ কাজ। এই ঘুষ-লালিত দেহের ইবাদত আল্লাহ কবুল তো করবেনই না বরং তাদের জন্য লাঞ্ছনা, আখিরাতের আগুণ অপেক্ষা করছে।
ইয়াহূদীদের দুর্গতির কারণ হিসেবে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ سَمَّٰعُونَ لِلۡكَذِبِ أَكَّٰلُونَ لِلسُّحۡتِ ﴾ [المائ‍دة: ٤٢]

“তারা মিথ্যা শ্রবণে অত্যন্ত আগ্রহশীল এবং অবৈধ (ঘুষ) ভক্ষণে অত্যন্ত আসক্ত।” (আল-কুরআন, ৫:৪২)
অপর একটি আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَتَرَىٰ كَثِيرٗا مِّنۡهُمۡ يُسَٰرِعُونَ فِي ٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡعُدۡوَٰنِ وَأَكۡلِهِمُ ٱلسُّحۡتَۚ لَبِئۡسَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٦٢ ﴾ [المائ‍دة: ٦٢]

“হে নবী! আপনি (আহলে কিতাবদের) অনেককেই দেখবেন পাপে, সীমালঙ্ঘনে ও অবৈধ ভক্ষণে (ঘুষ খাওয়াতে) তৎপর। তারা যা করে নিশ্চয় তা নিকৃষ্ট।” (আল-কুরআন, ৫:৬২)
আয়াতে ‘অবৈধ ভক্ষণ’ তরজমা করা হলেও হাদীসে এই ‘সুহত’ বা অবৈধ আয়কে ঘুষ হিসেবে তাফসীর করে দেওয়া হয়েছে। তবে সকল প্রকার দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত আয়ও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
এই ঘুষের বিষয়টি পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতে স্পষ্টতই এসেছে। বিচারের রায়কে প্রভাবিত করা এবং প্রশাসকদেরকে নিরপেক্ষতা ও ন্যায়নিষ্ঠতা থেকে আলাদা করাই যে ঘুষের মূখ্য উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তা প্রতিফলিত হয়েছে এই আয়াতে:

﴿ وَلَا تَأۡكُلُوٓاْ أَمۡوَٰلَكُم بَيۡنَكُم بِٱلۡبَٰطِلِ وَتُدۡلُواْ بِهَآ إِلَى ٱلۡحُكَّامِ لِتَأۡكُلُواْ فَرِيقٗا مِّنۡ أَمۡوَٰلِ ٱلنَّاسِ بِٱلۡإِثۡمِ وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ١٨٨ ﴾ [البقرة: ١٨٨]

“তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনেশুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকদের বা প্রশাসকদের কাছে পেশ করো না।”
 (আল-কুরআন, ২: ১৮৮)
এ আয়াতে ‘হুক্কাম’ অর্থ শাসকগণ, প্রশাসনগণ, বিচারকগণ হতে পারে। আরবী ভাষায় হাকিম বা বহুবচনে হুক্কাম শব্দটি এইসব অর্থে সমানভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কথা বুঝানো হয়েছে যাদের সিদ্ধান্তে একজনের সম্পদে অন্য কেউ অন্যায়ভাবে ভাগ বসাতে পারবে। উপর্যুক্ত আয়াতে وتدلوا بها শব্দটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এর অর্থ হচ্ছে ‘বালতি কুপে ফেলে তা টেনে উঠানো।’ ঠিক তেমনি ঘুষের রশিতে নিজের প্রত্যাশিত বস্তু টেনে আনা হয়। এটি রুপক অর্থে এসেছে।
এজন্যই আল্লামা আলুসী তার তাফসীর রুহুল মা‘আনীতে বলেন: “তোমাদের সম্পদের কিছু অংশ অসাধু বিচারক বা প্রশাসকদেরকে ঘুষ হিসেবে দিও না।”
তাফসীরে মাদারেকেও এ আয়াতের ‘বাতেল’ শব্দ দ্বারা ঘুষ বা রিশওয়াহ বুঝানো হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[6] এতে প্রমাণিত হলো যে, পবিত্র কুরআনে ঘুষের বিরুদ্ধে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
আজ আমাদের দেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে তালিকার প্রথম দিকে রয়েছে। এই দুর্নীতির নানা রকমের রয়েছে। তবে ঘুষ হচ্ছে প্রধান ও সবচেয়ে ব্যাপক দুর্নীতি। ঘুষের এই ব্যাপকতা কেবল আখিরাতের জন্যই ভয়াবহ নয়; বরং আমাদের এই সামাজিক জীবনেও দুর্ভোগের কারণ।
ঘুষের বিষয়টি এখন আর লুকোছাপা নেই; তা এখন সবারই জানা। বাসে, লঞ্চে, পথে-ঘাটে মানুষ ঘুষের আলাপ করছে। আমাদের আশপাশের লোকজন তা শুনেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। এ রকম অবস্থার কারণেই আমরা জাতি হিসেবে ক্রমশ বোধহীন হয়ে পড়েছি এবং ভবিষ্যতের অজানা লা‘নত অথবা দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি অথবা সন্ত্রাসের আরও প্রকোপ দেখে এক বিরাট ভয় আমাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ধর্মের বাণী আজ আমাদের জীবনে বাস্তব রূপ ধরে আসলেও আল্লাহর হুকুম পালন করার প্রতি আমাদের আগ্রহ নেই, যা দুঃখজনক হলেও সত্য। এ হচ্ছে এক ভয়াবহ অবস্থা।
ঘুষ আমাদের জাতীয় উন্নয়নকে ব্যাহত করছে। ঘুষের কারণে মানুষ যোগ্যতার মূল্যায়ণ পাচ্ছে না। ঘুষের চিন্তায় যখন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাথা ঘুরতে থাকে তখন হাতের কলম সিরাতুল মুস্তাকীমে চলে না। ঘুষ হচ্ছে সমাজদেহে নীরব মরণ ব্যাধি। সকল নীতি-নৈতিকতা, সমস্ত আইন-কানুন, বিধি-বিধানকে বিধ্বস্ত করে দেওয়ার জন্য ঘুষ নামক এই নমরুদই দায়ী। এ হচ্ছে এক মরণ ভাইরাস যা আমাদের সমাজের সকল ব্যবস্থাপনাকে নাজেহাল করে দিচ্ছে। এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে না পারলে আমাদের উপর আল্লাহর রহমত নাযিল হবে না এবং আমরাও একটি সময় অতীতের নমরূদ, ফিরাউনদের ন্যায় অভিশপ্ত জাতিতে পরিণত হব ও আল্লাহর গজবে ধ্বংস হয়ে যাব। কালব- এর পরিশুদ্ধির জন্য দেহ পরিশুদ্ধ থাকতে হয়। হালাল রুজি বা সৎ উপার্জনকারী আল্লাহর বন্ধু বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন। পক্ষান্তরে অসৎ উপার্জন করে অতি তাড়াতাড়ি সুখের সন্ধান করা আসলে বৃথা। অনেকেই অর্থ উপার্জনে সুবিধাজনক বিষয়ে লেখাপড়া শেষ করেই তার পেশায় এমনভাবে মগ্ন হয় যেন সে পারে তো দু দিনেই বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে যায়। লোকের সেবা করা এবং এজন্য ত্যাগী মনোভাব নিয়ে কাজ করার কোনো লক্ষণই দেখা যায় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে এই তাড়াহুড়া করে অসৎভাবে উপার্জন করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন:

«إن نفسا لا تموت حتى تستكمل رزقها فاتقوا الله وأجملوا في الطلب، ولا يحملنكم استبطاء الرزق أن تطلبوه بمعاصي الله، فإن الله لا يدرك ما عنده إلا بطاعته».

“কোনো প্রাণী তার রিযিক পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কখনও মরবে না। সাবধান! আল্লাহকে ভয় করো এবং আবেদনে সৌন্দর্য বজায় রাখো। তোমার রিযিক ধীরগতিতে আসার কারণে তা আল্লাহর নাফরমানির মাধ্যমে চেয়ো না। কারণ তাঁর নিকট যা আছে তা লাভ করতে হলে তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমেই করতে হবে।” 
(বাযযার, ইবন মাসউদ রা. হতে)
তবে কেউ যদি অন্যের সম্পদ গ্রাস করে তবে তার পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿  فَبِظُلۡمٖ مِّنَ ٱلَّذِينَ هَادُواْ حَرَّمۡنَا عَلَيۡهِمۡ طَيِّبَٰتٍ أُحِلَّتۡ لَهُمۡ وَبِصَدِّهِمۡ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ كَثِيرٗا ١٦٠ وَأَخۡذِهِمُ ٱلرِّبَوٰاْ وَقَدۡ نُهُواْ عَنۡهُ وَأَكۡلِهِمۡ أَمۡوَٰلَ ٱلنَّاسِ بِٱلۡبَٰطِلِۚ وَأَعۡتَدۡنَا لِلۡكَٰفِرِينَ مِنۡهُمۡ عَذَابًا أَلِيمٗا ١٦١ ﴾ [النساء: ١٥٩،  ١٦١]

“যারা ইয়াহূদী ছিল, তাদের যুলুমের কারণে আমরা তাদের ওপর এমন সব পবিত্র বস্তু হারাম করে দিয়েছি, যা ছিল তাদের জন্য হালাল। এছাড়াও আল্লাহর পথে অনেক বাধা দেওয়ার জন্য তা করেছিলাম এবং তারা সুদ গ্রহণের কারণে- যা তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল এবং অন্যায়ভাবে লোকের ধনসম্পদ গ্রাস করার জন্য। কাফিরদের মর্মন্তুদ শান্তি প্রস্তুত রেখেছি।”
 (আল-কুরআন, ৪:১৬০-১৬১)
এমনিভাবে অসৎ উপার্জন করে গাড়ি-বাড়ি, বিত্ত-বৈভব, প্রভাব-প্রতিপত্তি লাভ করার যে তীব্র আকাঙ্খা মানুষের মনে জাগে এবং শয়তান এইসব অপকর্মকে আকর্ষণীয় ও লোভনীয় করে সামনে তুলে ধরে, এর পরিণতি দুনিয়া ও আখিরাতে ভয়াবহ!
ইসলামে ঘুষ সম্পূর্ণরূপে হারাম। ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহিতা উভয়ে জাহান্নামী।
তাই আসুন, আমরা তওবা করে ঘুষকে পরিত্যাগ করি, এর বিরুদ্ধাচরণ করি। একে ঘৃণা করি, একে প্রতিরোধ করি। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দিন। আমীন।
বাঁচার উপায়: 
রোগের চিকিৎসার চেয়ে তার প্রতিরোধই হচ্ছে উত্তম ব্যবস্থা। এ জন্য  ঘুষ লেনদেন সংঘটনের পূর্বেই তার সুযোগ ও সম্ভাবনাকে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ, শিক্ষা -প্রশিক্ষণ  ও বাস্তব ভিত্তিক সর্মসূচীর মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করার পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়াও নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
ক.আখিরাতের চেতনা জাগ্রতকরণ:
দুনিয়ার জীবনই মানুষের শেষ নয় বরং মৃত্যুর পর মানুষকে আখিরাতের অনন্ত জীবনে প্রবেশ করতে হবে। সেদিন আল্লাহ তা‘আলার দরবারে দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি কর্মের হিসাব দিতে হবে। মূলত আখিরাতের চেতনা মানুষের জীবনে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে থাকে। যে ব্যক্তি আখিরাতে সত্যিকার বিশ্বাস করে সে কখনও ঘুষ গ্রহন করতে পারে না। মানুষের দুনিয়ার জীবন হচ্ছে অতি সংক্ষিপ্ত এবং আখিরাতই হচ্ছে অনন্ত জীবন। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে:

﴿ بَلۡ تُؤۡثِرُونَ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا ١٦ وَٱلۡأٓخِرَةُ خَيۡرٞ وَأَبۡقَىٰٓ ١٨ ﴾ [الاعلا: ١٦،  ١٨]

 “বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে বেশী প্রধান্য দিচ্ছ। অথচ আখিরাত সর্বোত্তম এবং চিরস্থায়ী” (সূরা আল আ‘লা: ১৬-১৭ )
এ চেতনা যখন মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হবে, তখন সে অবশ্যই এ থেকে বিরত থাকবে।
খ.হালাল হারামের দিক-নির্দেশনা দান:
অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে জনগণকে হালাল-হারামের দিক নির্দেশনামূলক শিক্ষা প্রদান করা উচিত। কেননা ইসলাম হালাল বা বৈধ বিষয় উপার্জনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে এবং হারাম উপার্জন বর্জন করার নির্দেশ দিয়েছে, এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَكُلُواْ مِمَّا رَزَقَكُمُ ٱللَّهُ حَلَٰلٗا طَيِّبٗا وَٱشۡكُرُواْ نِعۡمَتَ ٱللَّهِ إِن كُنتُمۡ إِيَّاهُ تَعۡبُدُونَ ١١٤﴾ [النحل:114]

“আল্লাহ তোমাদের হালাল এবং পবিত্র যা দিয়েছেন তা হতে তোমরা আহার কর এবং আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, যদি তোমরা কেবল তারই ইবাদত কর।”
 (সূরা আন নাহল: ১১৪)
রাজনৈতিক ও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ অনেক সময় অর্থ আত্মসাৎ করে থাকেন। অবৈধভাবে যে কোনো প্রকার অর্থ আত্মসাৎকে ইসলাম হারাম  ঘোষণা করেছে।
গ. দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতি মুক্ত হওয়া:
চাকুরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি সততা, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রদান করা জরুরী। কারণ এ সমস্ত চাকুরি প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের নিকট আমানত। ইসলাম এ সমস্ত আমানত তার যোগ্য প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُكُمۡ أَن تُؤَدُّواْ ٱلۡأَمَٰنَٰتِ إِلَىٰٓ أَهۡلِهَا ٥٨ ﴾ [النساء: ٥٨]

“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যেন আমানত তার যথার্থ মালিককে প্রত্যার্পণ কর।” 
(সূরা আন-নিসা: ৫৮)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ الإِمَامُ رَاعٍ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ

“তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। নেতা তার অধীনস্থদের জন্য জবাবদিহী করবেন।”[7]
ঘ. উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদানঃ
প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প বেতনের কারণে মানুষ ঘুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে। এজন্য ইসলাম প্রত্যেককে এমন মজুরি বা বেতন প্রদানের কথা বলেছে যে তা দ্বারা সে তার ন্যায়ানুগ ও স্বাভাবিক প্রয়োজন মেটাতে পারে। শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِنَّ إِخْوَانَكُمْ خَوَلُكُمْ جَعَلَهُمُ اللَّهُ تَحْتَ أَيْدِيكُمْ، فَمَنْ كَانَ أَخُوهُ تَحْتَ يَدِهِ، فَلْيُطْعِمْهُ مِمَّا يَأْكُلُ، وَلْيُلْبِسْهُ مِمَّا يَلْبَسُ، وَلاَ تُكَلِّفُوهُمْ مَا يَغْلِبُهُمْ، فَإِنْ كَلَّفْتُمُوهُمْ مَا يَغْلِبُهُمْ فَأَعِينُوهُمْ»

“তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। কারো ভাই তার অধীনে থাকলে তার উচিত নিজে যা খাবে তাই খাওয়াবে। নিজে যা পরবে তাকেও তা পরতে দিবে এবং তাকে দিয়ে এমন কাজ করাবে না যা তার সাধ্যাতীত। কোনভাবে তার উপর আরোপিত বোঝা বেশি হয়ে গেলে নিজেও সে কাজে তাকে সাহায্য করবে।”[8]
ঙ. যোগ্যঅভিজ্ঞ ও সৎ কর্মচারি নিয়োগ দান:
প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ঘুষ ও উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে অদক্ষ, অনভিজ্ঞ ও অসৎ কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে এসব কর্মকর্তা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েই তার বিনিয়োগকৃত সমুদয় অর্থ উত্তোলনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অতএব প্রশাসনকে ঘুষের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করার জন্য সৎ, বিশ্বস্ত ও অভিজ্ঞ লোক নিয়োগ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে বলেন,

﴿ إِنَّ خَيۡرَ مَنِ ٱسۡتَ‍ٔۡجَرۡتَ ٱلۡقَوِيُّ ٱلۡأَمِينُ ٢٦ ﴾ [القصص: ٢٦]

“তোমার জন্য সর্বোত্তম কর্মচারী হতে পারে সেই ব্যক্তি, যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত।"
(সূরা আল কাসাস: ২৬)

﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُكُمۡ أَن تُؤَدُّواْ ٱلۡأَمَٰنَٰتِ إِلَىٰٓ أَهۡلِهَا﴾ [آل عمران: 58]

এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যেন আমানত তার মালিককে প্রত্যার্পণ কর।” 
(সূরা আন নিসা: ৫৮)
এভাবে ইসলাম সৎ, যোগ্য ও বিশ্বস্ত কর্মচারী নিয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি সংঘটনের সম্ভাবনা বন্ধ করে দিতে চায়।
চ.গণসচেতনতা সৃষ্টি:
ঘুষ গ্রহণ এক ধরণের দুর্নীতি। এ দুর্নীতির ভয়াবহতা এবং এর নেতিবাচক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে সকল স্তরের মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। যাতে সমাজের প্রতিটি মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়। বিষয়টি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। কেননা এদেশের জনগণ ধর্মভীরু এবং সরল প্রকৃতির। তাদেরকে যদি ঘুষের ক্ষতিকর প্রভাব এবং তার ইহকালীন ও পরকালীন পরিণতির বিষয় বুঝিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তা খুব সহজে  প্রতিরোধ সম্ভব। দেশের সকল প্রচার মাধ্যম জনমত ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এজন্য রেডিও, টেলিভিশনসহ পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে যদি জনগণকে এর কুফল ও ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন করা যায়, তাহলে তা ঘুষ প্রতিরোধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে।
ছ. প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ:
শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের জন্য জবাবদিহিতার কোনো বিকল্প নেই। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত জবাবদিহিতার নিশ্চিতকরণ অফিস আদালতে ঘুষের লেনদেন প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল। আর তোমরা প্রত্যেকে স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”[9]
জ. ঘুষগ্রহীতাদের  উপযুক্ত শাস্তি প্রদানঃ
সমাজ থেকে ঘুষ-বাণিজ্য চিরতরে উচ্ছেদ করতে হলে শুধুমাত্র উপদেশ, সতর্কবাণী ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা করেই তার দায়িত্ব শেষ করলে চলবে না বরং কোনো ব্যক্তি যদি এ কাজে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করবে, যেন মানুষ শাস্তির পরিণতির ভয়ে ঘুষের লেনদেন থেকে দূরে থাকে।
ঝ.মানুষের অধিকার আদায়ের ব্যপারে সচেষ্ট হওয়া:
ঘুষের মাধ্যমে যে সমস্ত অপরাধ সংঘটিত হয় তার অধিকাংশই মানুষের অধিকার বিষয়ক। যেমন, যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ প্রদান, প্রমোশন প্রদান, সুযোগ-সুবিধা, স্বজনপ্রীতি ও অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ ইত্যাদি। অধিকারের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি ক্ষমা না করলে আল্লাহও ক্ষমা করবেন না।
ঞ. সম্পদ অর্জনে ইসলামী নীতি অবলম্বন:
সম্পদের মোহ এবং উচ্চাভিলাষী জীবন-যাপনই ঘুষের লেনদেনের অন্যতম প্রধান কারণ। মানুষ মৃত্যুর কথা এবং আখিরাতকে ভুলে এসবে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এজন্য আল-কুরআনে বারবার মৃত্যু ও আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে বলা হয়েছে, “প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।” (সূরা আলে ইমরান: ১৮৫ )
তাছাড়া হাদীসে এসেছে,

«ازْهَدْ فِي الدُّنْيَا يُحِبَّكَ اللَّهُ، وَازْهَدْ فِيمَا فِي أَيْدِي النَّاسِ يُحِبُّكَ النَّاسُ»

“পার্থিব ভোগ-বিলাস পরিত্যাগ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। আর লোকের কাছে যা আছে তার লালসা পরিত্যাগ কর। তাহলে অন্যরা তোমাকে ভালবাসবেন।”[10]
তাই অর্থ উপার্জনে হালাল-হারামের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।
ট.মানব মর্যাদার মাপকাঠি তাকওয়া:
মানুষ দ্রুত বিত্তের অধিকারী হওয়ার জন্য সাধারণত ঘুষ গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিত্তশালীর চেয়ে বিত্তহীনের বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে মর্যাদার মাপকাঠি অর্থবিত্ত নয় বরং ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে যে যতবেশী তাকওয়াসম্পন্ন বা আল্লাহভীরু, সে ততবেশী মর্যাদাবান। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

﴿إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ﴾ [الحجرات: ١٣]

নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত যে অধিক আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বনকারী।”
 ( সূরা আল-হুজুরাত:১৩)

বর্তমানে ঘুষ বাণিজ্য এ দেশকে ধ্বংস ও অধঃপতনের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করছে। অথচ সরকার নির্বিকার। আগামী দিনের সুস্থ-সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় এটি অবশ্যই পরিত্যজ্য। এটি যত আলোচিত হবে জনগণ এ বিষয়ে তত সচেতন হবে এবং তার সুফল ভোগে সমর্থ হবে। এ প্রবন্ধে উল্লেখিত পদক্ষেপসমূহ যদি সমাজে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে সমাজ থেকে ঘুষ-দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। সরকারের উচিত দুর্নীতি দমন কমিশনকে কার্যকরী ও অর্থবহ করার মাধ্যমে ঘুষ-বাণিজ্য প্রতিরোধে এগিয়ে আসা।


[1] হাদীসটি ইবন মাজাহ সংকলন করেছেন, হাদীস নং ২৩১৩।
[2] আবু দাউদ, সুলাইমান ইবন আশআশ, আস-সুনান, ৩য় খন্ড (সিরিয়া, হিমস: দারুল হাদীস, তা.বি), পৃ. ৩৫৩, হাদীস নং-২৯৪৩।
[3] সুবুলুস সালাম, খ. ৪, পৃ. ১২৪।
[4] আহমদ ইবন হাম্বল, আল-মুসনাদ, ২য় খন্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮৭।
[5] কানযুল উম্মাল, খ. ৩।
[6] খ. ১, পৃ. ৭৬।
[7] ইমাম বুখারী, সহীহুল বুখারী, ২য় খন্ড, বাবুল জুম‘আ ফিল ক্বুরা ওয়াল মুদুন, পৃ. ৫, হাদীস নং- ৮৯৩।
[8] বুখারী, হাদীস নং ২৫৪৫।
[9] ইমাম বুখারী, সহীহুল বুখারী, ২য় খন্ড, বাবুল জুম‘আ ফিল ক্বুরা ওয়াল মুদুন, পৃ. ৫, হাদীস নং- ৮৯৩।
[10] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৪১০২।

ইসলাম এবং মানবাধিকার



  • নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি ওয়া নুসাল্লিম আ'লা৷।ইমামুস সাক্বালাইনি।।আম্মা বা'দঃ-        

প্রারম্ভিকা :

অশান্ত পৃথিবীর বিক্ষুব্ধ জনতার আর্তচিৎকারের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে উন্মুক্ত গগনের মুক্ত পবন আজ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। বিশ্বে কোটি কোটি অভুক্ত বনু আদমের অমানবিক জীবন প্রবাহের নিদারুণ চিত্র সচেতন মানুষকে ব্যথিত করছে। পাশাপাশি তথাকথিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের ডামাডোলে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মারণাস্ত্র ব্যবসায়ের প্রতিযোগিতা আজ বিবেকবান সকল মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে।
অথচ (প্রায় ১৪ বছর পূর্বের) এক রিপোর্টে দেখা যায় বিশ্বে প্রতিদিন ১শ’ ১৫ কোটি শিশু অভুক্ত অবস্থায় রাত কাটায়।[1]    কি চমৎকার বৈপরীত্য?

শক্তিধর দেশগুলোর কাছে দরিদ্র ও ৩য় বিশ্বের জনগণ যেন বড় অসহায়। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের জনগণের অবস্থা আজ ত্রাহি ত্রাহি। বর্তমানে যারাই তথাকথিত মানবাধিকারের সবক দিতে আসে তাদের দ্বারাই তা পদলিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আবার তারাই ঐসব দরিদ্র দেশগুলোকে সাহায্যের লোভ দেখিয়ে এগিয়ে আসে। এ যেন সেই নীরিহ ছাগলের জন্য বাঘের সাহায্যের (?) হাত দেখানো। বিশ্বে শত শত বিলিয়ন ডলার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে ব্যয় হচ্ছে। অথচ ঐসব টাকা দিয়ে যদি গরীব মিসকীন অসহায় মানুষের খেটে খাওয়ার জন্য গরীব দেশগুলোতে মিল, কলকারখানা, হাসপাতাল প্রভৃতি কর্মমুখী ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হ’ত তাহ’লে লক্ষ কোটি মানুষ নির্বিঘ্নে তাদের জীবন পরিচালনা করতে পারত। প্রশ্ন হ’ল, এগুলো করলে শক্তিধর মোড়ল ধনী দেশগুলো তথাকথিত ‘মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার যিকির’ তো আর করতে পারবে না।

মানবাধিকার শব্দটি বর্তমান বিশ্বে ব্যাপক আলোচিত বিষয়। জাতিসংঘ  মানবাধিকার  সনদের বেশ  কিছু কনভেনশন বা প্রস্তাবনা রয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) পর ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় League of Nations বা ‘জাতিপুঞ্জ’।

এ সংস্থা উল্লেখযোগ্য কার্য বাস্তবায়ন করতে না পারায় ২য় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) গোটা বিশ্ব যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত, তখন কতিপয় রাষ্ট্রের উদ্যোগে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবরে বিশ্ব সম্প্রদায় ‘জাতিসংঘ’ গঠন করে। এরপর ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর ‘সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ’ নামে একটি ঘোষণা দেয়া হয়। যা বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিকট গৃহীত হয়। এক্ষণে মানবাধিকার আইন বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সর্বজনীন মানবাধিকার আইনের বিশ্লেষণ করতে গেলে নানা দিক নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন। সে সাথে ইসলামের আলোকে এর মূল্যায়নও জরুরী। নিম্নে মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনা করা হ’ল।-
‘মানবতা’ শব্দটির তাৎপর্য মানবতা শব্দের বিশ্লেষণে নিহিত। এই শব্দটি চারটি বর্ণ সমন্বয়ে গঠিত। তা হচ্ছে মা+ন+ব+তা। এর মধ্যে চারটি বিষয় নিহিত আছে। যেমন মা=মানুষ ন=নীতি, ব=বাস্তবায়ন, তা=তাগাদা। অর্থাৎ মানুষের নীতি বাস্তবায়নের তাগাদাই হ’ল মানবতা।[2] বিশেষ্যবাচক এ মানবাধিকার পদটিকে বিশ্লেষণ করলে পৃথক দু’টি শব্দ বেরিয়ে আসে। তার একটি হ’ল ‘মানব’ (HUMAN), অপরটি হ’ল ‘অধিকার’ (RIGHT)

অধিকার (Right) :

‘অধিকার’ শব্দটি ছোট হলেও এর গুরুত্ব ও প্রয়োগ বিশাল ও ব্যাপক। বিভিন্ন মনীষী বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে একে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। যেমন- কারও মতে, বর্তমান কালে ‘অধিকার’ বলতে আইন দ্বারা সীমিত একজন ব্যক্তির কোন কিছু করার স্বাধীনতা, কোন কিছু নিজের অধীনে রাখা বা অন্যের কাছ থেকে কোন কিছু গ্রহণ করাকে বুঝায়। আইনের ভাষায় বলা যায়, অধিকার হল- একটি স্বার্থ, যা সংবিধান বা সাধারণ আইন দ্বারা সৃষ্ট বা বলবৎযোগ্য হয়।[3]

এখানে স্মর্তব্য যে, অধিকারের সাথে ‘কর্তব্য’কথাটি সম্পৃক্ত। অন্যরা কর্তব্য পালন না করলে আমার পক্ষে অধিকার ভোগ করা সম্ভব নয়। যেমন- অন্যদের কর্তব্য হ’ল আমাকে পথ চলতে দেয়া। যদি তারা এ কর্তব্য পালন না করে, তাহ’লে আমার পথ চলার অধিকারের কোন অস্তিত্ব থাকে না। তেমনি আমার কর্তব্য হল, অন্যদের পথ চলতে দেয়া। আমি যখন অন্যদের পথ চলতে দেব, কেবল তখনই আমার নিজের পথ চলার অধিকার তাদের কাছ থেকে দাবী করতে পারব। তাই অধ্যাপক লাস্কি বলেন,
MY RIGHTS ARE BUILT ALWAYS UPON MY FUNCTION TO THE WELL BEING OF SOCIETY; AND THE CLAIM I MAKE MUST, CLEARLY ENOUGH, BE CLAIMS THAT ARE NECESSARY TO THE PROPER PERFORMANCE OF MY FUNCTION. MY DEMANDS UPON SOCIETY ARE DEMANDS WHICH OUGHT TO RECEIVE RECOGNITION BECAUSE A RECOGNIZABLE PUBLIC INTEREST IS INVOLVED IN THEIR RECOGNITION. [4]

আধুনিক রাষ্ট্র উৎপত্তির পূর্বে মানুষের ‘অধিকার’এর জন্ম হয়েছে, না পরে হয়েছে- এ নিয়ে পন্ডিত মহলের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ মনে করেন, মানুষ পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণের পর থেকেই তার অধিকারের বিষয়টি চলে এসেছে। যেমন John locke-এর মতে,
মানুষ স্বভাবতঃই কিছু অধিকার নিয়ে জন্ম লাভ করে, যাকে প্রাকৃতিক অধিকারও বলা হয় এবং যা প্রাক রাষ্ট্রীয় যুগেও বর্তমান ছিল।

পক্ষান্তরে Gettel-এর মতে,
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে মানুষের অধিকার ভোগ করা সম্ভব নয়। কেননা রাষ্ট্র অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা না দিলে সে অধিকার অর্থহীন। অতএব রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্রীয় আইনই অধিকার সৃষ্টি করে এবং তা ভোগ করার নিশ্চয়তা দেয়।[5] অর্থাৎ অধিকার হ’ল, সেই বিষয়বস্ত্ত যা মানুষের জন্ম থেকে শুরু হয়, যাকে আমরা প্রাকৃতিক অধিকার বলে থাকি, যা আধুনিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পূর্ব থেকে ছিল। অতঃপর সেই অধিকারগুলো  মানুষ আধুনিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এনে আরও সুন্দর, সাবলীল, গ্রহণযোগ্য করে আইনী কাঠামোতে রূপান্তরিত করেছে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যাচ্ছে, মানুষের অধিকার কিছু জন্মগত হ’লেও সবকিছু রাষ্ট্র দ্বারা সৃষ্ট ও রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। প্রচলিত আইন বিজ্ঞানীদের যুক্তি হ’ল রাষ্ট্র যতক্ষণ না কোন অধিকার সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন করবে ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ আইনত ও ব্যবহারগত কোন অধিকার আদায় করতে পারবে না। তাই এখানে রাষ্ট্র মানুষের অধিকার আদায়ে ব্যর্থ হ’লে সব ব্যর্থ। বাস্তবে গণতন্ত্রকামী দেশগুলোতে এক্ষেত্রে ব্যর্থতার চিত্রই দেখা যাচ্ছে।

আধুনিক রাষ্ট্রে আইন প্রণেতাগণ জনগণের চাহিদানুযায়ী আইন প্রণয়ন করে অথবা একটাতে সমাধান না হ’লে দ্রুত ভিন্ন আর একটা আইন রচনার রাস্তা বের করতে হয়। বাংলাদেশে জনগণের জন্য এরকম অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা জনগণের কল্যাণের (?) জন্য স্বাধীনতাত্তোর ৪০ বছরে অন্তত ১৫বার সংবিধান সংশোধন করেছে।তবুও এদেশের মানুষের অধিকার আদায় ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। আমেরিকা, ফ্রান্স, ভারত সহ সব দেশে অসংখ্যবার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। তবু তারা তাদের অধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেন হালে পানি পাচ্ছে না। সবটাতে গোল-পাক খাচ্ছে। বিষয়টি অতীব কঠিন। কারণ, প্রকৃত অর্থে আইন বিজ্ঞানীগণ অধিকার সম্পর্কে যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা অস্পষ্ট এবং অপূর্ণাঙ্গ। প্রচলিত এ সংজ্ঞা ও আইনের কোন স্থিতি নেই; নেই কোন কমিটমেন্ট। ফলে তার কার্যকারিতাও নেই। তাই মানুষকে আসতে হয় ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে।

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকেঅধিকার :

ইসলামে রয়েছে মানুষের অধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত সুসংবদ্ধ নীতিমালা ও ব্যাখ্যা। মানুষের নিজস্ব যুক্তি-বুদ্ধি সেখানে অচল। ইসলামের সে ব্যাখ্যার মধ্যে রয়েছে মানবতার রক্ষাকবচ। 
তাইতো মহান আল্লাহপাক কুরআন মজীদে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন,

وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلاَ مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَمْراً أَنْ يَكُوْنَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَن يَعْصِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاً مُّبِيْناً-

‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) কোন বিষয়ে ফায়ছালা করলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর নিজেদের কোন ব্যাপারে অন্য কোন সিদ্ধান্তের এখতিয়ার থাকবে না। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে তো স্পষ্ট পথভ্রষ্ট হবে’ (আহযাব ৩৬)।

উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, মানুষের কল্যাণকর্ম তথা অধিকারের ক্ষেত্রে কারও কোন কমবেশী করার সুযোগ নেই এবং কোনরূপ সংশোধন করারও সুযোগ নেই। ইসলামে অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর সম্পর্কিত। শাসক-শাসিতের সম্পর্ক কেমন হবে তা উল্লেখ আছে। একইভাবে পিতা-মাতার উপর সন্তানের, সন্তানের উপর পিতা-মাতার অধিকার কেমন হবে তার ঘোষণা রয়েছে। অনুরূপভাবে স্ত্রীর উপর স্বামীর, স্বামীর উপর স্ত্রীর, নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, সঙ্গী-সাথী, গরীব-মিসকীন, নিঃস্ব, ইয়াতীম, মুসাফির, হিন্দু, খৃষ্টান, রোগী, অসহায় ব্যক্তি, শ্রমিক সহ পৃথিবীর সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে পরস্পরের উপর অধিকার কেমন হবে তা ইসলামে নির্ধারিত রয়েছে। এমনকি জীব-জন্তু, পশু-পাখির সাথেও কেমন আচার-আচরণ করতে হয় তার স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। কিন্তু অনেক আধুনিক পন্ডিত তা জানে না। 
যেমন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বিষয়ে তোমাদের উপর ইহসান অত্যাবশ্যক করেছেন। অতএব তোমরা যখন হত্যা করবে, দয়ার্দ্রতার সাথে হত্যা করবে। আর যখন যবেহ করবে, তখন দয়ার সঙ্গে যবেহ করবে। তোমাদের সবাই যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং তার যবেহকৃত জন্তুকে কষ্টে না ফেলে’। [6]

তিনি আরো বলেন,
‘যে ব্যক্তি একটি চড়ুই পাখি যবেহর সময়ও দয়া প্রদর্শন করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার প্রতি দয়া করবেন’। [7]

অন্য এক হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘যে জিনিসের মধ্যে প্রাণ আছে, তোমরা তাকে লক্ষ্যবস্ত্ত বানিও না’। [8]

এ রকম বহু দৃষ্টান্ত দেয়া যাবে ইসলাম মানুষ ও সৃষ্টিকুলের জন্য কত উদারতা ও মহানুভবতা দেখিয়েছে। অথচ বহু বছর ধরে অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী ও আইন প্রণেতাগণ মানুষের অধিকার সম্পর্কে আধো আধো হ’লেও কিছু যুক্তি-দলীল পেশ করেছেন, কিন্তু পশু-পাখির উপর নিষ্ঠুর আচরণ করা যাবে না মর্মে কোন দেশের সংবিধানে কোন আইন লিখিত আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু চিরন্তন অবিস্মরণীয় এক শাশ্বত বিধান ইসলামে শত শত বছর পূর্বে তা সংরক্ষিত রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে পৃথিবী যতদিন টিকে থাকবে। সুতরাং এ কথা আমরা দ্বিধাহীনচিত্তে ঘোষণা করতে পারি যে, অধিকার বিষয়ে মানুষ প্রদত্ত সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা নয়; কুরআন-ছহীহ সুন্নাহতেই তার চমৎকার সমাধান রয়েছে।

আইনগত অধিকার (Legal Rights) :

আইনগত অধিকার হ’ল সে অধিকার যা কোন আইন দ্বারা স্বীকৃত ও সংরক্ষিত থাকে। এটা রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান বা আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত ও বাস্তবায়িত হয়। এটা কেউ লংঘন বা অমান্য করলে তা দন্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। যেমন- আমার পথ চলার অধিকার, ধর্মীয় কাজ সম্পন্ন করার অধিকার। এ কাজে কেউ বাধা দিলে তার প্রতিকার পাওয়া যাবে। কিন্তু কোন বিড়ালের সাথে নিষ্ঠুর আচারণ করা হ’লে [9] বা ভিক্ষুকের সাথে যদি খারাপ আচরণ করা হয়, তবে তার কোন আইনগত প্রতিকার পাওয়ার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কাজেই বৃহত্তর অর্থে আইনগত অধিকার বলতে আমরা সেই অধিকারগুলোর কথা বলতে পারি যা কেবল রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আইনের আওতায় রচিত।

ইসলামের দৃষ্টিতে আইনগতঅধিকার :

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের জন্য কতগুলো অধিকার রয়েছে যা ইসলামী রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের পক্ষে কোন সংস্থা কর্তৃক প্রণয়ন ও বলবৎ হয়ে থাকে। তবে এটা কুরআন-ছহীহ সুন্নাহর বাইরে নয়। এই আইন কেউ লংঘন করলে তাকে শাস্তি পেতে হয়। যেমন- মালিকানার অধিকার, মজুরী প্রাপ্তির অধিকার, মোহরানা প্রাপ্তির অধিকার, প্রতিশোধ ও প্রতিদানের অধিকার ইত্যাদি। তদ্রূপ কেউ কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করলে পাল্টা ইসলামী আদালত দ্বারা কিছাছ বা মৃত্যুদন্ড পেতে হবে। অনুরূপ স্ত্রীর মোহরানা পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক, কেউ চুরি করলে তাকে শাস্তি পেতে হয়। 
যেমন আল্লাহ বলেন,

وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُواْ أَيْدِيَهُمَا جَزَاءً بِمَا كَسَبَا نَكَالاً مِّنَ اللهِ وَاللهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ-

‘পুরুষ কিংবা নারী চুরি করলে তাদের হস্ত ছেদন কর, তা তাদের কৃতকর্মের ফল এবং আল্লাহর নির্ধারিত আদর্শ দন্ড, আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়’ (মায়েদাহ ৩৮)।

অনুরূপভাবে আমানতের মাল আমানত গ্রহণকারীর কোন প্রকার কাজের ফলে বিনষ্ট না হয়ে আপনা হ’তে বিনষ্ট হয়ে গেলে আমানত গ্রহণকারীকে কোনরূপ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না’। [10]

ইবনু ওমর (রাঃ) সূত্রে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
এক মহিলা একটি বিড়ালের কারণে জাহান্নামে গিয়েছিল। সে তাকে বেঁধে রেখেছিল। সে তাকে খাবারও দেয়নি, ছেড়েও দেয়নি, যাতে সে যমীনের পোকা-মাকড় খেতে পারত’। [11] পরে বিড়ালটি মারা গেল। এখানে কেবল ইসলামী আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জনগণের পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা রয়েছে তাই নয়, বরং তা পশু-পাখিসহ সকল ক্ষেত্রে অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে রচিত হয়েছে।

মানবাধিকার (Human Rights) :

সমকালীন প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার যে অর্থ বহন করে, কয়েক দশক আগেও এর অর্থ এরূপ ছিল না। তাই সংজ্ঞা হিসাবে ‘মানবাধিকার’ শব্দটি কলা বিজ্ঞান ও আইন বিজ্ঞানে খুব সাম্প্রতিক সংযোজন। ‘মানবাধিকার’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হ’ল মানবের অধিকার। অর্থাৎ মানুষ হিসাবে প্রতিটি মানব সন্তানের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত অধিকার সমূহ হচ্ছে মানবাধিকার। প্রতিটি মানুষের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সমূহ এর অন্তর্ভুক্ত। আরো বিস্তৃত পেক্ষাপটে মানবাধিকার পৃথিবীর সমস্ত ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা, গোষ্ঠী, লিঙ্গ, নির্বিশেষে মানুষের অবিচ্ছেদ্য অধিকারগুলো তার সত্ত্বার সাথে একীভূত হয়ে পড়ে। প্রতিটি মানব সন্তান মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েই হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করে ক্রন্দন ধ্বনি উচ্চারণের মাধ্যমে তার অধিকারগুলো ব্যক্ত করে সারা বিশ্বের কাছে তার অধিকারের কথা জানিয়ে দেয়।[12]
এখানে কেবল মানুষের অধিকারের বিষয়টি এসেছে। আসলে মানুষের সাথে সম্পর্কিত সব ধরনের আচার-ব্যবহার, নীতি, আচরণ, ব্যবস্থা রীতি, আইন বিধি, কার্যক্রম ও কার্যব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রয়োজন ও চাহিদা, প্রয়োগ ও প্রযুক্তি, জ্ঞান ও বিজ্ঞান, কার্য, চিন্তা জীবন, জড়জগৎ, চিন্তাজগৎ, প্রাণী জগৎ তথা বিশ্ব প্রকৃতির সবকিছু মানবাধিকারের সাথে সম্পৃক্ত।[13] যেমন- আমার গৃহে নিরপদ্রপ জীবন-যাপন যেমন আমার অধিকার, প্রাপ্ত বয়স্ক দু’জন অবিবাহিত যুবক-যুবতীর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও সন্তান উৎপাদনও তাদের তেমন অধিকার। সেন্সরশীপ আরোপ করে মত প্রকাশ, প্রচার ও কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি যেমন মানবাধিকার লঙ্ঘন, ঠিক তেমনি আইন সম্মত কারণ ও পরোয়ানা ব্যতিরেকে গ্রেফতার, আটক, নির্যাতন, হয়রানি সবই মানবাধিকার লঙ্ঘন।

এখনও বাংলাদেশ সহ বিশ্বে লক্ষ-কোটি নিরপরাধ বনু আদম বিনা বিচারে যুগ যুগ ধরে কারাগারে নিক্ষিপ্ত রয়েছে। একটি স্বাধীন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য প্রফেসরদেরকেও মিথ্যা মামলায় বছরের পর বছর বিচারের কাঠগড়ায় অমানবিকভাবে হাজিরা দিতে হয়। এটা কি মানবাধিকারের লংঘন নয়?

এক সময় কেউ কেউ বলেছেন, মানুষের অধিকার ও মানবাধিকার এক জিনিস নয়। কারণ মানবাধিকার যাকে এক সময় বলা হ’ত পুরুষের অধিকার (Rights of man)। যেখানে অধিকার বলতে পুরুষেরই ছিল, নারীর কোন অধিকার ছিল না।

এখানে তাই স্পষ্টত নারী-পুরুষের বৈষম্যের আভাস পাওয়া যায়। Thomas Paine সর্বপ্রথম ফ্রান্সে জাতীয় পরিষদ কর্তৃক ১৭৮৯ সালে গৃহীত ‘পুরুষের অধিকার’ ফরাসী ঘোষণার ইংরেজী (French Declaration of Rights of man and of the citizen) অনুবাদ মানবাধিকার পদ্ধতিটি ব্যবহার করেন। পুরুষের অধিকার বললে তাতে নারীর অধিকার অন্তর্ভুক্ত হয় না বলেই পরবর্তীকালে মিসেস এলিয়ন রুজভেল্টের প্রস্তাবানুযায়ী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ১৯৪৮ সালের ১০ই ডিসেম্বর গৃহীত সর্বজনীন ঘোষণায় ‘মানবাধিকার’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।[14] তাই মানবাধিকার এখন জাতি-ধর্ম-বর্ণ, ভাষা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় দু’টো বৈশিষ্ট্য হ’ল একটি সহজাত অপরটি হস্তান্তর অযোগ্য। Paul Sheiegart মনে করেন এই বৈশিষ্ট্য দু’টির কারণেই মানবাধিকার অন্যান্য অধিকার থেকে আলাদা এবং অধিক মর্যাদাসম্পন্ন।[15]

ক্লাসিক্যাল যুগ থেকে মধ্যযুগ হয়ে রেনেসাঁর শেষ সময়কাল পর্যন্ত বিভিন্ন মনীষীর রচনায় মানবাধিকারের ধারণা ও পরিচয় মেলে। যেমন- ফ্রান্সের বঁদীন ও জীন জ্যাক রুশো, ইটালীর হুগো প্রোটিয়াস, ইংল্যান্ডের জন লক, ভ্যাটেল ও ব্লাক স্টোন এবং জার্মানীর কার্ল মার্কস। এঁদের লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে যে, ‘মানুষ’ হিসাবে মানুষ কিছু প্রাকৃতিক অধিকার ভোগ করার অধিকারী। কিন্তু কোন শাসক যখন মানুষকে এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে তখনই তারা সোচ্চার হয়েছে, প্রতিবাদী হয়েছে। সুতরাং এ অধিকার শাসকেরা অনায়াসে মানুষকে দেয়নি, দিয়েছে একেবারে নিরুপায় হয়ে। ফলশ্রুতিতে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রণীত হয়েছে বিভিন্ন দলীল যেগুলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে সংরক্ষিত হয়েছে মানুষের অধিকার। যেমন- ইংল্যান্ডের ১২১৫ সালের Magna carta, ১৬২৮ সালের Petition of Rights, ১৬৮৯ সালের Bill of Rights ইত্যাদি। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, মানবাধিকারের ধারণার বিকাশ ঘটেছে স্বেচ্ছাচারী শাসকদের স্বৈরতন্ত্রের ফল হিসাবে। কথাটি অকপটে স্বীকার করেছেন  সাধারণ  পরিষদের  তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আফগানিস্তানের Mr. Abdur Rahman Pazhwak। ১৯৬৬ সালে মানবাধিকার বিষয়ক দু’টো আন্তর্জাতিক চুক্তি গৃহীত হবার পর তিনি বলেছিলেন, ‘Universal respect for human Rights is inseparable from world peace. At the root of all strife and tyranny, in the present as in the past, lies a violation of human rights in one form or another.[16]

উপরের আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, সমস্ত অধিকার মানুষের প্রকৃতিতে সহজাত ও হস্তান্তর অযোগ্য, যেগুলো পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য জাতি, বর্ণ, গোত্র, নারী-পুরুষ, রাজনৈতিক বা অন্যান্য অভিমত ইত্যাদি নির্বিশেষে সমভাবে প্রযোজ্য ও উপভোগ্য (equally applicable to and enjoyable by), যেগুলো মানুষের ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য এবং যেগুলো ছাড়া মানুষ ‘মানুষ’ হিসাবে বেঁচে থাকতে পারে না সেগুলোই মানবাধিকার।

আর আইনগতভাবে বলা যায় যে, অধিকারগুলো মানবাধিকার হিসাবে বিশ্বের রাষ্ট্র সমূহ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মাধ্যমে যে চুক্তি বা সনদ প্রণয়ন করেছে সেগুলো হল মানবাধিকার। এর ব্যবহার ও প্রয়োগ সমানভাবে সকল রাষ্ট্রের উপর বর্তায়। যদিও এটা বর্তমানে বিতর্কিত। সনদগুলোর মধ্যে যেমন- Universal Declaration of Human Rights of 1948 (UDHR), International Covenant of civil and political Rights of 1966 (ICCPR), International Covenant on Economic, Social and Cultural Rights of 1966 (ICESCR) ইত্যাদি। বিশ্ব ব্যবস্থায় বর্তমানে UDHR হ’ল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য মানবাধিকার সনদ। তবে এই সনদের ধারা ও প্রয়োগ বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। তাই একে সর্বজনীন আইনগত মানবাধিকার হিসাবে সর্বত্র প্রয়োগ সম্ভব নয়। কেননা এটা কোন রাষ্ট্র মানতেও পারে, আবার নাও পারে। কিন্তু অন্যত্র দৃষ্টি দিলে আমরা দেখব ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স সহ যেকোন দেশের সংবিধানে স্বীকৃত ও চিহ্নিত মানবাধিকারগুলো হ’ল আইনগত মানবাধিকার। কারণ এসব মানবাধিকার ঐসব রাষ্ট্রের সংবিধানে গৃহীত ও স্বীকৃত। বাংলাদেশ সংবিধানের ২য় ভাগে উল্লেখিত মূলনীতি অধিকার এবং ৩য় ভাগে উল্লেখিত মৌলিক অধিকারগুলো হ’ল আইনগত মানবাধিকার। কেউ এটা লংঘন করলে তার উপযুক্ত প্রতিকারের ব্যবস্থা রয়েছে।

কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লংঘন করলে তার প্রতিকারের বিধান রয়েছে বটে, কিন্তু তার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। কারণ জাতিসংঘ তথা জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদ কয়েকটি পরাশক্তিধর দেশের হাতে বন্দী হয়ে পড়েছে। কায়েমী স্বার্থ ও হিংসার কবলে সেই মানবাধিকার ও মানবাধিকার সংস্থা যেন কারও কারও দাবার গুটি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ এই মানবাধিকার এর উৎপত্তি ও ব্যবস্থা কখনও স্থায়ী ও সর্বজনীন ছিল না। সর্বদা আইনের অনুমিত ধারণা বশতঃ হয়ে সংযোজন-বিয়োজন চলছে। অথবা আইনের ফাঁক-ফোকরে বিশ্বে বিভিন্ন প্রান্তে তার যথেচ্ছ ব্যবহার করে যাচ্ছে। জাতিসংঘের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য তাদের ভেটো পাওয়ার প্রয়োগ করছে। যেমন ফিলিস্তীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি না দেওয়ার ব্যাপারে এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো পাওয়ারই যথেষ্ট। যদিও গোটা বিশ্ব সম্প্রদায় ফিলিস্তীনীদের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন দেয়। একইভাবে মিথ্যা গোয়েন্দা তথ্য অথবা কাল্পনিক তথ্যের উপর নির্ভর করে জাতিসংঘকে ব্যবহার করে ইঙ্গ-মার্কিন কর্তৃক ইরাককে ধ্বংস করা হয়। যেখানে ১৯৯২ সালে হামলার পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ১০ লাখ নারী বিধবা এবং ৪০ লাখ শিশু ইয়াতীম হয়েছে। ২৫ লাখ মানুষ হতাহত হয়েছে এবং ৮ লাখ নিখোঁজ রয়েছে।[17]

এরই নাম আমেরিকার মানবাধিকার রক্ষা (?)অথচ আমরা বলি, বিশ্ব ব্যবস্থাপনা ও শান্তির গ্যারান্টি তথা মানবাধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত ব্যবস্থা রয়েছে শ্বাশত বিধান ইসলামে। যা কোন মানুষ থেকে আসেনি। সরাসরি মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাাল্লাম)-এর মাধ্যমে এসেছে। সুতরাং এতে সামান্যতম কোন সন্দেহ বা কোনরূপ ভুলের আশঙ্কা নেই।
কুরআনে বলা হয়েছে,

ذَلِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيْهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِيْنَ

‘এটা সেই গ্রন্থ, যার মধ্যে কোনরূপ সন্দেহ নেই। আল্লাহভীরুদের জন্য এ গ্রন্থ হিদায়াত বা মুক্তিপথের দিশারী’ (বাক্বারাহ ২)।
এটা অপব্যবহার করারও কোন সুযোগ নেই। তেমনি এটা সংশোধনেরও ঊর্ধ্বে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইসলামে যুগ-জিজ্ঞাসার জবাব তথা সমাধান বের করার ক্ষেত্রে গবেষণার মাধ্যমে কুরআন-ছহীহ সুন্নাহর আলোকে ইজতিহাদের দুয়ার খোলা রাখা হয়েছে। এটা ক্বিয়ামত পর্যন্ত সকল যুগের সকল যোগ্য আলেমের জন্য খোলা থাকবে।

মানবাধিকারের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ :

যতদূত জানা যায়, সর্বপ্রাচীন লিপিবদ্ধ আইন হচ্ছে রাজা হামুরাবি কর্তৃক প্রণীত বেবিলনীয় কোড (প্রায় ২১৩০-২০৮৮ খ্রীঃপূঃ) বা হামুরাবি কোড। লিখিত আইনের সূচনা হিসাবে এই ‘কোড’ খুব মূল্য বহন করে এবং পরবর্তীতে মানুষের অধিকার সংরক্ষণে রীতি-নীতি ও প্রথার চেয়ে লিপিবদ্ধ আইন অধিকতর ফলপ্রসূ হিসাবে বিবেচিত।[18]

এরপর সর্বপ্রথম যে আইনে মানুষের অধিকার যৎকিঞ্চিত হ’লেও ব্যক্ত করা হয়, তা হ’ল সিংহরাজের রাজত্বকালে সাইবেরীয়ান ব-দ্বীপে প্রণীত আইন। তবে এই আইনে জনগণের মৌলিক অধিকারের কথা উল্লেখ না থাকলেও তার সামনে দেশে সামন্ত প্রভু ও অভিজাত ব্যক্তিদের একটি সভা ডাকা হ’ত, যা বর্তমান কালের সাথে কিছুটা তুলনাযোগ্য। ১১৮৮ খৃষ্টাব্দে রাজা নবম আলফানসের নিকট থেকে এই সভা অভিজাত শ্রেণীর জন্য বেশ কিছু অধিকার আদায় করে নেয়। এসব অধিকারের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়। সেগুলোর মধ্যে ছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা, জীবনের নিরাপত্তা, জীবনের মর্যাদা, বাসস্থান ও সম্পদের অলংঘনীয়তা। অর্থাৎ আইন ব্যতিরেকে তাদেরকে শারীরিকভাবে আটক, নির্যাতন, অসম্মান বা আইনানুগ বিচার ছাড়া কাউকে শাস্তি প্রদান বা কারও প্রাণ হরণ করা চলবে না; আইনসঙ্গত উপায় ব্যতিরেকে নিজ বসতবাটিতে তাদের বসবাসে অসুবিধা সৃষ্টি করা চলবে না বা উচ্ছেদ করা যাবে না ইত্যাদি।[19]

পরবর্তীতে হাঙ্গেরীর রাজা ২য় এন্ড্রু ১২২২ সালে স্বর্ণা আদেশ দ্বারা রাজকীয়ভাবে ‘সিংহসাম্রাজ্যের’ মত ঘোষণা দেন যে, কোন রাজা বা আমীরকে প্রথমে কোন আইনে অভিযুক্ত করা ছাড়া আটক বা হত্যা করা চলবে না। এখানে আদালত কর্তৃক নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে আমীরকে বিচার কার্যের কথা স্বীকার করা হয়েছে। রুডলফ ভন ঝেরিং (১৮৫২-১৮৭৮) প্রায় সোয়াশ’ বছর আগে উল্লেখ করেছেন যে, প্রাচীন রিপাবলিকান রোমে রাষ্ট্র কর্তৃক রোমান নাগরিকদের (বিদেশী বা দাসদের জন্য এ আইন নয়) সরকারের অংশগ্রহণে, সরকার নির্বাচনে, ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করার, সরকারী কর্মকর্তা নির্বাচন করার এমনকি পুলিশ প্রশাসনে অংশগ্রহণ করার অধিকার দেয়া হয়েছিল।

প্রখ্যাত আমেরিকান মনীষী ইয়ানটেমান (১৯৫৮) দেখিয়েছেন যে, রোমান আইন ব্যবস্থা রোমান পন্ডিত ও আইনজ্ঞদের দ্বারা প্রণীত। এ আইন ব্যবস্থায় মানুষের অধিকার প্রয়োগ ও সংরক্ষণের যৌক্তিক উপায় রাখা হয়েছিল, যাতে করে সর্বসাধারণ তাদের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য আদালতের শরণাপন্ন হ’তে পারে। সর্বপ্রথম রোমান সমাজেই ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল। ইয়ানটেমানের এই অভিমত বর্তমানে ইউরোপ এবং যেসব দেশে কমন ‘ল’ চালু আছে সেসব দেশে গুরুত্ব সহকারে প্রযোজ্য। রোমান সমাজে যেগুলো মানুষের অধিকার বলে স্বীকৃত ছিল, তার প্রকাশ ও প্রতিফলন ইংলিশ ম্যাগনাকার্টাতে দেখা যায়। ইংল্যান্ডের রাজা জন রানীমেড নামক স্থানে ১২১৫ সালে এই ঐতিহাসিক দলীল গ্রহণ করতে বাধ্য হন। [20]

তবে একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে,মানুষের অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতকে ইসলাম ধর্ম অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।যার ভিত্তিতে পরবর্তীতে বিশ্বমানবতার মুক্তি ও কল্যাণের জন্য মানব অধিকার বিষয়ক শব্দটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ গ্রহণ করে। তবে সমকালীন প্রেক্ষাপটে ‘মানবাধিকার’ যে অর্থ বহন করে, কয়েকশতক আগেও এর অর্থ এরূপ ছিল না। তাই সংজ্ঞা হিসাবে মানবাধিকার শব্দটি কলাবিদ্যায় ও আইন বিজ্ঞানে খুব সাম্প্রতিক সংযোজন। সেজন্য বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় শতকে ‘মানবাধিকার’, ‘মানুষের অধিকার’, ‘মৌলিক অধিকার’ কথাগুলো দ্বারা আসলে ঐ সমস্ত অধিকারকেই বোঝানো হয়, যেগুলো ১৮ শতকের শেষ ভাগ থেকে ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের মাধ্যমে সৃষ্ট এবং ফরাসী (১৭৮৯) ও আমেরিকান (১৭৭৬) বিপ্লবের মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত।[21]
প্রকৃতপক্ষে ঐ বিপ্লব দু’টির মাধ্যমেই‘মানবাধিকার’ শব্দের আধুনিক অর্থের আনুষ্ঠানিক গোড়াপত্তন হয়। যা নিয়ে আজ বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সরগরম।
-----------------------------------------------------------
[1]. দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ই আশ্বিন, সোমবার, ১৪০৪ বাংলা।
[2]. ডঃ আনসার আলী খান, আন্তর্জাতিক আইন (ঢাকা: কামরুল বুক হাউস), পৃ. ৪২২।
[3]. Dr. A.B.M. Mofijul Islam Patwari and Md. Akhtaruzzaman, Elements of Human Rights and legal Aids, (Dhaka), P. 1.
[4]. ড. রেবা মন্ডল ও ড. শাহজাহান মন্ডল, মানবাধিকার আইন সংবিধান ইসলাম এনজিও (ঢাকা : শামস পাবলিকেশন্স), পৃঃ ১-২।
[5]. প্রাগুক্ত।
[6]. মুসলিম হা/৪৯৪৯, অধ্যায়-৩৫, অনুচ্ছেদ-১১; মিশকাত, হা/৪০৭৩ ‘শিকার ও যবেহ’ অধ্যায়।
[7]. 
[8]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪০৭৬ ‘শিকার ও যবেহ’ অধ্যায়।
[9]. মানবাধিকার আইন সংবিধান ইসলাম এনজিও, পৃঃ ৩।
[10]. বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন, সংকলনে : গবেষণা পরিষদ (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), পৃঃ ৪২১।
[11]. বুখারী হা/৩০১৮।
[12]. মোঃ মাহবুব-উল হক জোয়ার্দ্দার, আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে মানবাধিকার ( ঢাকা : বাংলা একাডেমী), পৃঃ ১।
[13]. তদেব ১ম খন্ড।
[14]. মানবাধিকার আইন সংবিধান ইসলাম এনজিও, পৃঃ ৩-৪।
[15]. তদেব, ১ম খন্ড, পৃঃ ৪।
[16]. তদেব, ১ম খন্ড,পৃঃ ৪-৫।
[17]. মাসিক আত-তাহরীক, ১৪তম বর্ষ, ১১তম সংখ্যা, আগষ্ট ২০১১, পৃঃ ৪৪।
[18]. আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে মানবাধিকার, পৃঃ ৮।
[19]. তদেব, ১ম খন্ড, পৃঃ ৯।
[20]. মানবাধিকার আইন সংবিধান ইসলাম এনজিও, পৃঃ ৭।
[21]. আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে মানবাধিকার, পৃঃ ৬-৭

Featured post

ইসলামী অর্থনীতি কি? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও তাঁর রাসূল (সা.) প্রদত্ত জীবন বিধানের নাম ইসলাম। যেহেতু ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান সেহেত...